ঘুরে আসুন কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধ
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ। শাহবাগ মোড়ের বামপাশে পিজি হাসপাতাল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। ডানপাশে বারডেম হাসপাতাল। (ইব্রাহিম ডাইবেটিব্স হাসপাতাল)। উল্টো দিকেই মুখ ফেরালে জাতীয় জাদুঘর। তার পাশেই জাতীয় গণগ্রন্থগার (পাবলিক লাইব্রেরী)।
জাতীয় গণগ্রন্থগারের সাথে লাগোয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। চারুকলা অনুষদের সামনে ছবির হাট। ছবির হাট দিয়েই প্রবেশ করা যায় স্বাধীনতা জাদুঘরে। সেটা স্থাপিত হয়েছে রেসকোর্স ময়দানের শিখা চিরন্তনির পাশেই। ছবির হাটের সামনে চারুকলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন মেইনগেটের সাথেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধ স্থাপিত।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরপরই বিদ্রোহী কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। গানের মাধ্যমে ব্যাক্ত শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশেই সমাহিত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি (ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র) অতিক্রমের সময় অনেকেই কবির সমাধি দেখতে আসেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পত্নী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান । কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। তিনি স্থানীয় মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে যখন তার বাবা মারা যান তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল) দলে যোগ দেন।
১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি।
১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯২২ সালে বিজলী (বিদ্রোহী) কবিতা প্রকাশিত হওয়ামাত্রই জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালী মানসিকতায় কবিতাটি চির উন্নত শির বিরাজমান। বল বীর – বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির! বল বীর – বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’ ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর! মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! বল বীর- আমি চির উন্নত শির যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ।
এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্।
১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কবি তার একটি কবিতায় বলেছিলেন: ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’ এই কবিতায় তার অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়।